বিশ্ব পুঁজিবাদ ও উন্নয়ন-অনুন্নয়নের আবর্তে তৃতীয় বিশ্ব লেখকঃ মোঃ ইসহাক আলী খন্দকার সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
বিশ্ব পুঁজিবাদ ও উন্নয়ন-অনুন্নয়নের আবর্তে তৃতীয় বিশ্ব লেখকঃ মোঃ ইসহাক আলী খন্দকার সহযোগী অধ্যাপক, অর্থনীতি ব্রজমোহন বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
অর্থনৈতিক দিক থেকে পৃথিবী আজ দুটো শিবিরে বিভক্ত উন্নত এবং উন্নত অনুন্নত। অনুন্নত দেশগুলোকে তৃতীয় বিশ্বের দেশ বলা হয়। এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা অধিকাংশ দেশ তৃতীয় বিশ্বের সদস্য এবং পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তৃতীয় বিশ্বের অধিবাসী। এখন প্রশ্ন জাগে তৃতীয় বিশ্ব অনুন্নত কেন? বিশ্ব উন্নয়নের সঠিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে বিশ্ব সম্পদের অসম বন্টন এর মূল কারণ। একদিকে উন্নত দেশগুলোতে সম্পদের প্রাচুর্য এবং অন্যদিকে অনুন্নত দেশের সম্পদের দুষ্প্রাপ্যতা --- প্রাচুর্যের ভিতর দারিদ্র্য ---- এ আপাততঃ বিরোধিতা উন্নত বিশ্ব অনুন্নত বিশ্বকে বিচ্ছিন্ন করে এক বিরাট ফাঁক সৃষ্টি করেছে। ইউরোপীয় বাণিজ্যবাদের আওতায় অসম বাণিজ্য শর্তের দারুন পুঁজিবাদী দেশগুলো মূলধন গঠন বৃদ্ধি করে দেশে দ্রুত শিল্পায়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধন করেছে। তাদের এরূপ উপনিবেশিক শাসন ও শোষণমূলক অসম বিকাশের ফলে কাঁচামাল ও প্রাথমিক পণ্য উৎপাদনকারী দেশগুলো অনুন্নয়ন ঘটেছে। অর্থনৈতিক এ অবস্থাকে 'কেন্দ্র--পরিধি সম্পর্কে বলে। অন্যদিকে কেন্দ্র বা উন্নত দেশগুলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতাবলে পরিধি বা অনুন্নত দেশগুলোর উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে শোষণ করে এবং অন্যদিকে পরিধি বা অনুন্নত দেশগুলো কেন্দ্রের ভাবেদারীতে শোষিত হয়ে পরনির্ভরশীল দেশ পরিণত হয়।
কেন্দ্র অঞ্চলের দেশগুলোতে একটা গতিশীল বুর্জোয়া শ্রেণীর নেতৃত্বে পুঁজির একত্রিকরণের মাধ্যমে পুঁজিবাদ এর উদ্ভব হয় যা ক্রমান্বয়ে বিশ্ব পুঁজিবাদে এ রূপান্তরিত হয়। বিশ্ব পুঁজিবাদ এর কাঠামো কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত পর্যন্ত বিস্তৃত। কেন্দ্রকে ঘিরে কতগুলো পরিকেন্দ্রিক চক্র রয়েছে এ চক্রগুলো একে অন্যের সাথে মিলে একাকার হয়ে কেন্দ্রের সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে সম্পৃক্ত হয়।
কেন্দ্রের মূল বিন্দুতে থাকে সর্বাধিক সম্পদশালী ও সামরিক শক্তিতে বলশালী দেশগুলো। এদের আনুগত্যের ছত্র-ছায়ায় সকল দেশের অবস্থান। কেন্দ্রের চতুর্দিক ঘিরে আছে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলো। তার পরে অবস্থান নিয়েছে কম শক্তিশালী। উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো। তারপরে আসে আরও কম শক্তিশালী দেশগুলো এবং সর্বোচ্চ প্রাপ্তদেশে অবস্থান নিয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা এবং ল্যাটিন আমেরিকার অনুন্নত দেশগুলো। কেন্দ্রে কর্তৃত্ব এবং প্রান্তে আনুগত্যের সম্পর্কের ভিত্তিতে এ সকল পরিকেন্দ্রিক চক্র মিলে গঠিত হয় বিশ্ব পুঁজিবাদের কাঠামোটি। এ কাঠামোর মধ্যে নিহত রয়েছে বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়ন অনুন্নয়ন প্রক্রিয়া।
বিশ্ব পুঁজিবাদ একটা আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। বিশ্বের দেশগুলো কেউ উন্নত কেউ অনুন্নত বা উন্নয়নশীল হলেও, এ সব দেশ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে একই সূত্রে গ্রথিত।
উপনিবেশবাদ, নয়া উপনিবেশবাদ, পুঁজিবাদ, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ সবাই নিজ নিজ সম্পর্কের ভিত্তিতে পরস্পর সংযুক্ত থেকে অধিপত্য, দাসত্ব, শাসন ও শ্বসন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে এবং প্রাপ্ত দেশগুলোকে দারিদ্রের দুষ্ট-চক্রে এবং নিম্নস্বরের ফাঁদে আটকে রাখে। প্রাপ্তের দেশগুলোকে যত বেশি অনুন্নত রাখা সম্ভব হয়েছে কেন্দ্রীয় দেশগুলো ততো উন্নত হয়েছে। উন্নয়ন-অনুন্নয়ন একটি ঐতিহাসিক ও দ্বান্দ্বিক পক্রিয়া যার ফলে এক দেশের উন্নয়ন অন্য দেশের অনুন্নয়নের কারণ হতে বাধ্য।
তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নয়নের জন্য এসব দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক (অর্থাৎ সঞ্চয় ও মূলধনের কম যোগান, প্রকৃতিক সম্পদের অভাব, দক্ষ উদ্যোক্তা ও শ্রমিকের অভাব, অনুন্নত সামাজিক বুনিয়াদ, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও মুক্তচিন্তার অভাব ইত্যাদি মত অভ্যন্তরীণ) উৎপাদনকে দায়ী করা হয়, কিন্তু আধুনিক আধুনিক অর্থনীতিবিদরা যুক্তি দেন যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো অনুন্নয়নের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ অবস্থা দায়ী নয় বরং বিশ্ব পুঁজিবাদের সাথে শর্ত সাপেক্ষে জড়িত হওয়াই এর মূল কারণ। নয়া উপনিবেশবাদী শোষণের মাধ্যমে বিশ্ব পুঁজিবাদ অনুন্নত বা নির্ভরশীল দেশ থেকে দ্বিগুণ পরিমাণ উদ্বৃত্ত আত্মসাৎ করেছে। ফলে এসব দেশে তাদের প্রকৃতিক
ও মানবিক সম্পদ উন্নয়নের জন্য সুষ্ঠুভাবে বিনিয়োগ করতে পারছেনা। বিশ্ব পুঁজিবাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ষড়যন্ত্র ও শোষণের ফলে এসব দেশ উন্নত দেশগুলোর কাঁচামাল যোগানদাতা এবং বহুজাতিক কোম্পানির লাভজনক বিনিয়োগের ক্ষেত্র হিসেবে গড়ে উঠেছে।
...পুঁজিবাদ বিশ্ব নিজেদের উন্নয়নের স্বার্থে তৃতীয় বিশ্বের গরিব দেশগুলোকে বৈদেশিক বিনিযোগ, সাহায্য, ঋণ এবং বাণিজ্যের মাধ্যমে উন্নয়নবিমুখ করে রাখে। যদিও তারা ভালো করে বাঁচার তাগিদে উন্নয়নমুখী হয়। বর্তমান সময়ে উন্নত দেশগুলোর বহুজাতিক সংস্থাগুলো (স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো যা তৃতীয় বিশ্ব এন,জি,ও, নামে পরিচিত) স্থায়ী কাঁচামাল ও সস্তা শ্রমের মাধ্যমে স্থায়ী বাজার দখল করে বিপুল পরিমাণ উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করে তার সিংহভাগ নিজ দেশে পাচার করছে এবং অবশিষ্টাংশ বিশ্ব পুঁজিবাদ এর দালাল, সেবাদাস এবং এজেন্টের মাধ্যমে ভাগ করে বিনিয়োগ স্থানের উপর আধিপত্য বিস্তার করছে। এমন কি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদেশি বাণিজ্য প্রযুক্তি বিদেশী ব্যাংক ও বীমা কোম্পানিগুলো এসব দেশের উপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে একদিকে বিশ্বে ঐক্যের সূত্র রচনা করেছে, অন্যদিকে আঞ্চলিকতাকে শক্তিশালী করে বিচ্ছিন্নতার ইন্ধন যোগাচ্ছে। শুধু অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে নয়, শিক্ষা, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং অনেক সময়, এমন কি রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ড পর্যন্ত নাক গলাচ্ছে যা কখনো কাম্য হতে পারে না।
বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব অর্থনীতির দিকে তাকালে মনে হয় যে উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলো পরস্পর একই রেখায় অবস্থান করে বিভিন্ন অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন সৃষ্টি করেছে এবং এদের মধ্যে নিজের স্বার্থ বজায় রেখে অনুন্নত দেশগুলোকে সাহায্য ও সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে চলেছে। এভাবেই বিশ্ব পুঁজিবাদ প্রান্তরের দেশগুলোকে কেন্দ্রের উপাঙ্গে উপস্থাপন করে অনুন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নের বদলে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করাতে বাধ্য করছে।
আজকে বিশ্ব পুঁজিবাদ বিভিন্ন রূপে প্রতিভাত হয় নায়া কলাকৌশল প্রযোগ করে তারা প্রতিপক্ষ সমাজতান্ত্রিক অর্থ ব্যবস্থাকে পঙ্গু করেছে এবং এমনকি শক্তিধর সোভিয়েত রাশিয়ার পতন নিশ্চিত করেছে। এভাবে পুঁজিবাদ বিশ্ব স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে এক অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহান শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। পুঁজিবাদের আধিপত্য শাসন ও শোষণ সম্পর্কে তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের যে বদ্ধমূল ধারণা তা পরিবর্তনের লক্ষ্যে পুঁজিবাদের নয়া সংস্করণ হিসেবে বাজার অর্থনীতি বা মুক্তনীতি আজ বিশ্বে চালু হয়েছে কিন্তু বাজার অর্থনীতির দক্ষতা প্রমাণের জন্য যেসব বৈশিষ্ট্য অনুন্নত দেশগুলোকে অপরিহার্যভাবে থাকার কথা তা এসব দেশে বহুলাংশে নেই বললেই চলে। তাই আরোপিত এ বাজার অর্থনীতিতে এসব দেশের কৃষি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি বিশ্ব অর্থনৈতির অবাধ প্রতিযোগীতায় টিকতে পারবে না। এবং দেশগুলো উন্নয়নের পরিবর্তন উন্নয়নের আবর্তে ঘুরপাক খাবে। বাজার অর্থনীতি মূলতঃ ব্যক্তির স্বার্থে পরিচালিত হয় সেহেতু এ ব্যবস্থা উন্নয়নের প্রাথমিক স্তরে বা স্বয়ংক্রিয় স্তরের পূর্বে চালু করলে অর্থনৈতিক উন্নত অব্যাহত হবে।
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের একটা অনুন্নত দেশ এবং বিশ্ব পুঁজিবাদের পরিকেন্দ্রিক চক্র বহির্ভূত নয়। বিশ্ব পুঁজিবাদের ললিত বিভিন্ন সংস্থার প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী এদেশের কাঠামোগত (Structural) এবং কার্যগত (Functional) বিভিন্ন সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ উন্নয়নমুখী নয় বরং উন্নয়ন বিমুখ। পুঁজিবাদ বা বাজার অর্থনীতি কখনো এদেশের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করতে পারে না যদি এ দেশের জনগণ তাদের নিজস্ব সম্পদ ও শক্তি যথাযথভাবে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের জন্য ব্যবহার করে। আকাশ হতে কোন দৈবশক্তি কাউকে উন্নত বা অনুন্নত করে এ পৃথিবীতে পাঠায়নি। এটা মানব সৃষ্ট। মানব শাসন ও শোষণের বিষময় ফল।
এটা বিশ্বাসযোগ্য যে, বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন প্রক্রিয়ার সম্পর্কগুলো সম্পর্কে নিরপেক্ষ ও সঠিক মূল্যায়ন করতে পারলে তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ (বাংলাদেশ সহ) তাদের অনুন্নয়নের মূল কারণ অচিরে বুঝতে পারবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ ও তা প্রয়োগ সক্ষম হবে।
No comments
Thanks for your comment.